Hot Posts

6/recent/ticker-posts

ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক না করতে মোদিকে ভারতের চাকমা নেতাদের চিঠি

 

‘‘ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক না করতে মোদিকে ভারতের চাকমা নেতাদের চিঠি ’’

 জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিরোধিতা

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক না করার আহ্বান জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়েছেন ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের চাকমা নেতারা। চিঠিতে তারা বাংলাদেশের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় মোদিকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান এবং দাবি করেন যে, বাংলাদেশে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতন চলছে। তাদের মতে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে আনা উচিত।

চিঠিতে দাবি করা হয় যে, বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর দীর্ঘদিন ধরে দমন-পীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক আদিবাসী নেতার মতে, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় বাঙালি জনসংখ্যা বাড়াতে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পাহাড়ি অঞ্চলে বাঙালিদের পুনর্বাসন করার অভিযোগ রয়েছে। এতে পাহাড়ি ও বাঙালি জনসংখ্যার সংখ্যা প্রায় সমান হয়ে যায়, যা আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনধারা এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে।

 চিঠির ঐতিহাসিক পটভূমি

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে একসময় জনসংখ্যার ৯৮.৫ শতাংশই ছিল অমুসলিম আদিবাসী। কিন্তু বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশন ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় অঞ্চলটি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের অংশ হয়। এই প্রক্রিয়ায় পাহাড়ি অঞ্চলে আদিবাসীদের জমি ও সম্পত্তি রক্ষার অধিকার অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়। বর্তমান সময়েও আদিবাসীদের জমি দখল, সম্পত্তি লুণ্ঠন এবং জীবনযাত্রায় বাধার ঘটনা ঘটে চলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

 আদিবাসী সম্প্রদায়ের দাবি ও প্রেক্ষাপট

চিঠিতে চাকমা নেতারা আরও অভিযোগ করেন যে, পাহাড়ি অঞ্চলে আদিবাসীদের ওপর বাঙালি সেটলারদের আক্রমণ ও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেক সদস্য তাদের নিজ ভূমি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এতে তাদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। তারা চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, আদিবাসীদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জাতিগত বৈষম্যের উদাহরণ।

চাকমা নেতারা মোদিকে অনুরোধ করেছেন যাতে তিনি বাংলাদেশের সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন, যেন আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ হয় এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া, আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমি ও সম্পত্তির সুরক্ষা এবং নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

 চিঠির দাবির প্রতিক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে পাঠানো এই চিঠি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। মোদির পক্ষে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করা আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থনের ইঙ্গিত দেবে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে এ ধরনের চিঠি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করা হলেও আদিবাসী নেতাদের বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, এবং এই সম্পর্কের ভিত্তি মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তবে আদিবাসী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ওঠা এই অভিযোগ ও চিঠি ভারতের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যাতে তারা বাংলাদেশে আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয়।

ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও বর্তমান পরিস্থিতি

পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও বর্তমান পরিস্থিতি বেশ জটিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় থেকে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব চলছে। একসময় চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে আদিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ছিল। কিন্তু ক্রমাগত ভূমি দখল, বাঙালি পুনর্বাসন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে আদিবাসীদের সংখ্যা কমে আসে এবং তাদের ভূমির অধিকার সংকুচিত হয়। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ‘শান্তি চুক্তি’ নামে পরিচিত। যদিও এই চুক্তির মাধ্যমে আদিবাসীদের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, বাস্তবে তার বাস্তবায়ন নিয়ে এখনও অনেক অভিযোগ রয়েছে।

বর্তমানেও পার্বত্য এলাকায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা, ভূমি নিয়ে বিরোধ এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীর কার্যক্রমের কারণে সহিংসতা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। চিঠিতে উল্লিখিত আদিবাসী নেতাদের মতে, বাংলাদেশের সরকার তাদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং বাঙালি সেটলারদের মাধ্যমে তাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ করণীয়

ভারতীয় আদিবাসী নেতাদের চিঠির প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে আরও স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের আহ্বান জানাতে পারে। একই সঙ্গে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অধিক মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হতে পারে।

আদিবাসী সম্প্রদায়ের সমস্যার সমাধানের জন্য বাংলাদেশের সরকারের উচিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো এবং সংলাপের মাধ্যমে তাদের দাবি পূরণের চেষ্টা করা। প্রশাসনের পক্ষে পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধানে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি। একই সঙ্গে, ভূমি অধিকার, নিরাপত্তা এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূরণে সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।


ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ্য করে ভারতীয় আদিবাসী নেতাদের এই চিঠি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে এসেছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের অভিযোগ, তাদের অধিকার রক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এ অবস্থায়, আন্তর্জাতিক মহল এবং প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে চাপ আসতে পারে, যাতে বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এ সমস্যার সমাধানে একমাত্র উপায় হলো সংলাপ, বোঝাপড়া ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।


Post a Comment

0 Comments